লাক্ষা বাংলাদেশের একটি লাভজনক অর্থকরী ফসল। সারা দেশের আবহাওয়া লাক্ষা চাষের উপযোগী। বর্তমানে বাংলাদেশে সারা বছরে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে লাক্ষা চাষ হয়। এ পরিমাণ জমি থেকে মাত্র ১৮০ টনের মতো ছাড়ানো লাক্ষা উৎপাদিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে লাক্ষার চাহিদা প্রায় ১২০০ টনের বেশি। বিশ্ব বাজারে লাক্ষার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে লাক্ষার বিভিন্নমুখী ব্যবহার এ চাহিদার মূল কারণ। লাক্ষা চাষ সম্প্রসারণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষিদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব।
লাক্ষাকীটের পোষক গাছঃ কুলগাছে কুল উৎপাদনের পাশাপাশি লাক্ষা চাষ করা যায়। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিনহাজার জমিতে কুল চাষ হয়। মোট উৎপাদন প্রায় তের হাজার টন এবং হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩.৫ টন। কুল গাছে লাক্ষা চাষ করলে যদিও কুলের ফলন শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কম হয়। তবুও কুলের চেয়ে কুল ও লাক্ষার চাষ একত্রে অধিক লাভজনক। কুলছাড়াও শিরিস, বট, পাকুর, পলাশ, পলাশ, খয়ের, বাবলা, ডুমুর, অড়হর, কসুম এসব গাছেও লাক্ষা ভালো জন্মে।
পোষক গাছ ছাঁটাইকরণঃ লাক্ষা কীটসমূহ  কেবলমাত্র গাছের কচি ডগা বা ডাল হতে রস শোষন করতে পারে সেজন্য যে পোষক গাছে লাক্ষা কীট চাষ করা হবে তার পাতা ও কচি ডগা খাবে তা আগেই ছাঁটাই করা উচিত।
শিশু কীট সংক্রমণঃ ভালো লাক্ষার ফলন কীট সংক্রমণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সে কারণে যেসব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে। তাহলো-
রোগবালাইমুক্ত; পরিপক্ক ও স্বাস্থ্যকর বীজ লাক্ষা ব্যবহার করা; বীজলাক্ষা গাছ হতে কাটার পর পরই সংক্রমণ করা; সংক্রমণের জন্য সঠিক পরিমাণ বীজলাক্ষা ব্যবহার করা; বীজলাক্ষা সমেত টুকরাটি এমনভাবে শোষক গাছের ডালে বাঁধতে হবে যেন সেটা গাছের ডালের সাথে বেশ ভালোভাবে লেগে থাকে। বীজ লাক্ষাগুলো  কচি ডালের যত কাছাকাছি বাঁধা যায় ততই ভালো; বীজলাক্ষা লাগানোর পর শিশু কীটগুলো গাছের কচি ডালে বসে গেলে যতশীঘ্র সম্ভব বীজলাক্ষার টুকরাগুলো সরিয়ে নিতে হবে।
কূপ পদ্ধতিতে লাক্ষা চাষঃ চক্রাকারে লাক্ষা চাষের মাধ্যমে পোষক গাছকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেয়া দরকার। কূপ পদ্ধতির মাধ্যমে একটি এলাকার পোষক গাছসমূহকে তিন বা চারভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত কোনো একটি কূপের সকল গাছে পোকা সংক্রমণ করা হয়। যখন ফসল পরিপক্ক হয় তখন অন্য কূপের গাছ সমূহকে সংক্রমিত করা হয়। এভাবে আগের কূপটির গাছসমূহকে নতুন পাতা ও ডগা বের হওয়ার যথেষ্ট সময় পায় ও সম্পূর্ণ প্রাণশক্তি ফিরে পায়।
নতুন ডালে লাক্ষা তৈরিঃ নতুন ডালে অবস্থান নেয়ার পর শিশুকীটগুলো তাদের চুলের মতো লম্বা শুর গাছের বাকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ও প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে। ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে এরা পাতলা উজ্জল রঙের রস নি:সরণ শুরু করে যা লাক্ষা নামে পরিচিত।  
ফসল কাটা, লাক্ষা ছাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণঃ লাক্ষা সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ক হওয়ার পর কাটা দরকার। জুন-জুলাই মাসে (আষাঢ়) বীজ লাক্ষা লাগালে অক্টোবর-নভেম্বর (কার্তিক) মাসে  ফসল সংগ্রহের সময় হয়। অক্টোবর-নভেম্বর (কার্তিক) মাসে বীজ লাক্ষা লাগালে এপ্রিল- মে (বৈশাখ) মাসে ফসল সংগ্রহের সময় হয়। পোষক ডাল হতে পরিপক্ক লাক্ষা দা বা কাঁচির সাহায্যে ছাড়াতে হয় যা ছাড়ানো লাক্ষা নামে পরিচিত। ছাড়ানো লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে চাঁচ, টিকিয়া ও গালা তৈরি করা হয়। একশ  কেজি ছাড়ানো লাক্ষা হতে ৬০ কেজি চাঁচ/ টিকিয়া/গালা পাওয়া যায়।
লাক্ষার সাথী ফসলঃ কুল,পলাশ, বাবলা, খয়ের কড়ই এসব গাছে সফলতার সাথে লাক্ষা চাষ হয়ে আসছে। পোষক গাছ জমিতে থাকলে সেখানে ছায়া পড়বে। তাই লাক্ষার সাথী ফসল হিসেবে ঐ সমস্ত শস্যকেই বেছে নিতে হবে  যেগুলো ছায়াযুক্ত বা আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে ভালো জন্মাতে পারে। লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা যেসব ফসলকে লাক্ষার উপযোগী সাথী ফসল হিসেবে তাহলো আদা, হলুদ, মুখীকচু, মিষ্টি আলু,ধান, গম এসব।
দেশের ভূমিহীন কিংবা প্রন্তিক চাষিরা নিজের এলাকার সরকারি, বেসরকারি সড়ক কিংবা মাঠঘাট প্রান্তরে জন্মানো পোষক গাছে লাক্ষা চাষ করে নিজেদের দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাক্ষা চাষ হলে দেশও এগিয়ে যেতে পারে অনেকদূর।